স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্তব্য ও স্ত্রীর উপর স্বামীর ২৯ টি হক বা দাবী
স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্তব্যঃ-
স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্তব্য ও স্ত্রীর উপর স্বামীর ২৯ টি হক বা দাবী
স্বামীর প্রতি স্ত্রীর প্রথম দর্শনেই উভয়ের মধ্যে বৈদ্যুতিক আকর্ষণের ন্যায় এক প্রকার আকর্ষণ এসে পড়ে। এতেই স্বামীর প্রতি স্ত্রীর আন্তরিক মিল হয়ে থাকে। সে মুহূর্ত থেকেই স্বামীর প্রতি স্ত্রীর অন্তকরণে এক প্রকার মধুর চিন্তার উদ্ভব হয়ে থাকে। নব জীবনের তরী গঠন স্পৃহা চিরতরে বিদায় গ্রহণ করে এবং ভবিষ্যত জীবনের কর্তব্যাবলী নবরূপ ধারণ করতে দেখা দেয়। স্বামীর প্রতি স্ত্রীর অন্তকরণে নব জাগরণ এসে কর্তব্যের পথ উদ্ভাসিত করে তোলে। তখন পিতা-মাতা, ভ্রাতা-ভগ্নি ও আত্মীয়-স্বজন পরিত্যাগ করে তাদের উভয়ের মধ্যে নবসূত্র স্থাপন করে। একে অন্যকে নিবিড়ভাবে ভালবাসতে আরম্ভ করে, ফলে তারা একে অন্যের চিরসঙ্গী হয়ে পড়ে।
সূচিপত্রঃ-
স্বামীর প্রতি স্ত্রীর ওয়াযিব কাজঃ-
স্ত্রী স্বামীকেই তার একান্ত কামনার বস্তু বলে মনে করে, এরূপ মনে করাই স্বাভাবিক। এটা আল্লাহরই ইচ্ছা। প্রথম মিলনের দিন থেকেই স্ত্রী তার স্বামীসেবা ও স্বামীর কুশল কামনা করতে আরম্ভ করে, এটা ওয়াযিব। জগতের সর্ববস্তু পরিত্যাগ করেও তারা ইহকালের ও পরকালের সঙ্গী স্বামীর খিদমতে লেগে যায়। পতিপ্রাণা স্ত্রী স্বামীর সৎ কাজে উৎসাহ ও অসৎ কাজে বাধা প্রধান করে। এরূপে উভয়েরই জীবন ধন্য করে।
স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্তব্য কুরআন ও হাদিসের আলোকে আলোচনা
এ বিষয়ে হযরত রাসূলে করীম (স) বলেছেন, স্বামীকে অসন্তুষ্ট করলে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন।
“যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও উদ্দেশ্য সিজদা করার নিয়ম থাকত, তাহলে
আমি স্ত্রীলোকদেরকে স্বামীকেই সিজদা করার নির্দেশ দিতাম।”
স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্তব্য সম্বন্ধে আল্লাহ তায়ালা কোরআনে বলেছেন, পুরুষগণ নারীদের প্রতি এজন্যই ক্ষমতাবান যে, (নারীর) উপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করেছেন, আর এজন্যও তারা ক্ষমতাবান যে, তাদের (পুরুষদের) ধন-সম্পত্তি (নারীদের জন্য) ব্যয় করে।
এ আয়াতের মর্মার্থ এ যে, পুরুষের পরিশ্রমলব্ধ টাকা পয়সা দ্বারা স্ত্রীর দেনমোহর দিতে হয় বলে স্ত্রীর উপর স্বামীর আধিপত্য। আল্লাহ তায়ালা আরও বলেছেন, “নারীগণও স্বামীর প্রতি অনুরক্ত থাকে এবং তাদের গুপ্তাপ্ত রক্ষা করে আল্লাহর রক্ষণের সাথে।” এ আয়াতের মর্মার্থ এটাই, সতী নারী স্বামীর ত্যাগ ও দয়ার দরুন তার প্রতি শ্রদ্ধাভক্তি করে এবং সাধ্য অনুযায়ী স্বামীর পূর্ণ খিদমত করে। সে নিজ গোপন স্থানকে অন্যের দৃষ্টি বা দর্শন থেকে আল্লাহর নিষেধাজ্ঞা অনুযায়ী রক্ষা করে ।
স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্তব্য হাদিসের বানী
স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্তব্য সম্বন্ধে জানার জন্য একজন স্ত্রীলোক হযরত রাসুল (সাঃ)-এর কাছে হাজির হয়ে জিজ্ঞেস করল, “হুজুর। আমার প্রতি আমার স্বামীর কিরূপ হক।” তিনি বললেন
(১) পথে চলার সময় উটের পিঠের উপরও যদি কেহ স্ত্রীর সাথে কামভাব পূর্ণ করতে চায়, তা হলেও তার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতে হবে।
(২) স্বামীর অনুমতি ছাড়া নফল রোযাও রাখতে পারবে না।
(৩) স্বামীর অনুমতি ছাড়া স্ত্রী অন্যত্র গেলে ফিরে না আসা পর্যন্ত স্ত্রীর উপর আযাবের ফেরেশতাগণ লা’নত বর্ষণ করতে থাকে।
(৪) স্ত্রী যদি স্বামীর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ না করিয়া স্বামীর কাছে হতে দূরে থাকে, তা
হল যে পর্যন্ত স্বামীর কাছে ফিরে না আসবে, ফেরেশতাগণ লানত করতে থাকবে।
(৫) যে স্ত্রীলোক পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে, রোযা রাখে, পর্দায় থাকে এবং স্বামীর খিদমত করে, সে জান্নাতের যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা সে দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে।
(৬) স্ত্রী যদি স্বামীর বিনা অনুমতিতে এক রাত্রির জন্যও অন্যত্র বাস করে, তা হলে সে ইবাদতে পাকা হলেও জাহান্নামের অতি নিম্নস্তর কারন ও হামানের সাথে। তাকে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে।
(৭) যদি কোন স্ত্রীলোক আসমান ও জমিনের বাসিন্দাদের বরাবর নেকী হাসিল করে, অথচ স্বামীকে কোন প্রকার কষ্ট দেয়, তা হলে আল্লাহ তায়ালা তার দু’ হাত ঘাড়ের সাথে ও দু’ পা শিকলে বেঁধে কদর্য চেহারায় আযাবের ফেরেশতার কাছে সোপর্দ করে দিবেন।
(৮) যে স্ত্রী স্বামীর দেয়া কাপড় পেয়ে অসন্তুষ্ট হয়, আল্লাহ তায়ালা তার উপর
অসন্তুষ্ট হবেন। যে স্ত্রী স্বামীর মাল নষ্ট করবে বা চুরি করবে, তার উপর সত্তর হাজার
ফেরেশতা লা’নত করতে থাকবে।
(৯) যে স্ত্রী স্বামীর মেহমানদের সমাদর করে না, তার উপর সমস্ত ফেরেশতা ও দুনিয়ার সমস্ত প্রাণী লা’নত করবে। স্ত্রী স্বামীকে অসন্তুষ্ট করলে আল্লাহও সে স্ত্রীর উপর অসন্তুষ্ট হন, আর স্ত্রী স্বামীকে খুশী করলে আল্লাহও তার সে স্ত্রীর উপর খুশী হন।
১০। স্ত্রী যদি স্বামীকে এ ধরনের কথা বলে, যাতে স্বামী রাগ হয়, তা হলে স্ত্রীর নাম মোনাফিক ও মোশরিকের দলে লিখা হয়ে যায়।
১১। আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন স্ত্রীলোকদের প্রথমে নামাযের বিষয় ও এরপর স্বামীর খিদমতের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করবেন। তখন যদি কেহ বলে যে, তারা স্বামীর খেদমত না করে আল্লাহর ইবাদত করেছে ও হাজার হাজার রোযা রেখেছে, তা হলেও তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।
১২। হযরত রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন, আমি বেশি স্ত্রীলোকদেরকেই জাহান্নামবাসি দেখেছি। একজন সাহাবী জিজ্ঞেস করলেন হে রাসূলুল্লাহ। জাহান্নামে বেশী স্ত্রীলোক যাবে এর কারণ কি? হযরত বললেন, “এরা অপরকে গালিগালাজ করে থাকে এবং নিজের স্বামীর বহু না-শোকরী করে থাকে।
হযরত ফাতিমার (রাঃ)-এর প্রতি রাসূলুল্লাহ (স)-এর নসীহতঃ-
হযরত মুহাম্মদ (স) তাঁর কন্যা ফাতিমাকে নিম্নলিখিত নসীহত করেছেন
(১) স্বামীগৃহে প্রথম প্রবেশ করার সময়ে “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম” বলবে।
(২) শরীর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখবে।
(৩) চোখে সুরমা ব্যবহার করবে।
(৪) মাথায়, শরীরে তৈল মেখে গোসল করবে।
(৫) স্বামীর সাথে সর্বদা হাসিমুখে সরল প্রাণে কথা বলবে এবং স্বামী যখন কোন
কিছু বলবে, তখন তুমি বিনম্র বদনে দৃষ্টি নিম্নগামী করবে।
(৬) দাসীর ন্যায় স্বামী সেবা করবে। প্রাণের সাথে তাকে ভালবাসবে ও সম্মান
করবে।
(৭) ঘরে সুগন্ধি দ্রব্য ব্যবহার করবে।
(৮) তিক্ত ও অম্ল অধিক খাবে না।
(৯) যে অবস্থায়ই থাক, ধৈর্য সহকারে সাংসারিক কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন
করবে।
(১০) শ্বাশুড়ীকে মাতার ন্যায় ভক্তি করবে ও তাঁর বাধ্য হয়ে চলবে।
স্ত্রীর উপর স্বামীর ২৯টি হক বা দাবী
স্ত্রীর উপর স্বামীর ২৯টি হক বা দাবী আছে; নিম্নে তা লিপিবদ্ধ করা হল
(১) হায়িয-নিফাছের নিষিদ্ধ সময় ব্যতীত অন্য যে কোন সময়ে স্বামী কামভাব
পূর্ণ করতে ইচ্ছা করলে তৎক্ষণাৎ স্ত্রী তা পূর্ণ করার জন্য প্রস্তুত হবে ।
(২) স্বামীর বিনা অনুমতিতে স্ত্রী সংসারের কোন বস্তু কাউকে দান করলে এর সওয়ার স্বামী প্রাপ্ত হবে। আর স্ত্রী স্বামীর পরিশ্রমলব্ধ বস্তু আত্মসাৎকারীরূপে সে পরিমাণ গুনাহগার হবে।
(৩) স্বামী কাছে উপস্থিত থাকা তার অনুমতি ব্যতীত স্ত্রী নফল রোযা রাখতে পারবে না। কারণ, স্ত্রীর সওয়াব গুনাহর উপলক্ষ স্বামী। জীবনে মরনে স্বামীই স্ত্রীর সর্বস্ব।
(৪) স্বামীর কাছে স্ত্রী আবশ্যকের অতিরিক্ত বস্তুর আবদার করতে পারবে না।
(৫) স্ত্রী স্বামীর সাথে একমত হয়ে সুখে-দুঃখে সহানুভূতির সাথে বসবাস করবে।
(৬) স্ত্রী স্বামীকে কোন লজ্জা দিবে না।
(৭) স্ত্রীকে সর্বদা স্বামীর মনোনীত কাজে রাজী থাকতে হবে এবং অমনোনীত কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।
(৮) স্বামীর প্রতি কোন রকম সন্দেহ হলে স্ত্রী বিনম্র ভাষায় সে সম্পর্কে জিজ্ঞা করবে এবং নিজের সন্দেহ দূর করবে।
(৯) এক বিছানায় শয়ন করবে, কখনও পৃথক বিছানা করবে না।
(১০) যতদূর সম্ভব পার, স্বামীর কাছে কাছে থাকবে, কখনও একা বেড়াতে যাবে না
(১১) স্বামীর সেবা যত্নের ছোটখাট ব্যাপারেও খুব মনোযোগ রাখবে।
(১২) স্বামীকে কখনও রাগ কর্কশ ভাষায় কথা বলবে না।
(১৩) স্বামীর বিনা অনুমতিতে বাপের বাড়ী বা আত্মীয়-স্বজনের বাড়ী যাবে না। তাদের কাছে চিঠি লিখলে স্বামীকে দেখিয়ে লিখবে।
(১৪) স্বামীর ভুল হলে মুখে মুখে তার প্রতিবাদ করবে না। সুযোগমত ঠাণ্ডা মেজাজে তার ভুল বুঝিয়ে দিবে।
(১৫) ঝগড়া হলে স্বামীর ঘর ছেড়ে অন্যত্র যাবে না।
(১৬) স্বামীর সাথে মনোমালিন্য হলে মুখ ভাড় করে রাখবে না। তখনের ঝগড়া
মিটিয়ে ফেলবে।
(১৭) স্বামী কাজে বের হবার সময়ে তার কাপড়-চোপড় নিজ হাতে গুচিয়ে দিবে।
(১৮) স্বামী বাড়ীর বের হয়ে যাওয়া পর্যন্ত তার সামনে সামনে থাকবে, তার
বিদায়ের সময়ে হাজির থাকবে, তাকে চুমা দিয়ে ‘খোদা হাফিয’ বলে বিদায় দিবে।
(১৯) স্বামীকে বিদায় দিয়ে ঘরে ঢুকে যতক্ষণ তিনি চোখের আড়াল না হন,
ততক্ষণ দরজায় বা বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকবে এবং কুশল জানাবে।
(২০) স্বামী কখন ফিরে আসবে সে অপেক্ষায় থাকবে।
(২১) বাড়ী ফিরে স্বামী কখনও তোমাকে কুশ্রী অবস্থায় ময়লা কাপড়ে দেখতে না পায় সেদিকে দিকে খেয়াল রাখবে।
(২২) স্বামী ঘরে এলে মেজাজ খুব ভাল রাখবে। ঘরে প্রবেশ করামাত্র হাসিমুখে তাকে অভ্যর্থনা জানাবে।
(২৩) স্বামীর হাত মুখ ধোয়ার পানি, বদনা, জুতা যথাস্থানে ঠিক করে রাখবে।
(২৪) গরমের দিন হলে খোলা জায়গায় তার বসার ব্যবস্থা করবে।
(২৫) স্বামী বিছানাতে বসামাত্র কাপড়-চোপড়, জামা-কাপড় খুলে তাকে সাহায্য করবে। গরমের দিন হলে পাখা দিয়ে বাতাস করবে এবং মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে।
(২৬) স্বামী ঘরে আসামাত্র তাকে কোন অশুভ সংবাদ দিবে না।
(২৭) তোমার অসুখ থাকলে প্রথমে স্বামীকে জানাবে না। আগে তিনি কেমন আছেন তা জিজ্ঞেস করবে। এরপর তোমার অসুখের কথা বলবে।
(২৮) স্বামী ঘরে আসামাত্র সাংসারিক অভাব-অনটনের কথা বলবে না। কত টাকা রোজগার করে এনেছে তাও জিজ্ঞেস করবে না।
(২৯) এক সাথে স্বামী স্ত্রী দু’জনে বসে খানা খাবে এবং খোশ আলাপ করবে।
সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে
রমণী সুন্দর হয় সতীত্ব রক্ষণে।’’
এমনিতেই স্ত্রী স্বামীর জন্য হয়ে থাকবে ফুটন্ত গোলাপ। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায়, অঙ্গসজ্জা এবং বেশভূষায় স্বামীর চক্ষুশীতল করবে। সৌন্দর্য ও
সৌরভে ভরা গোলাপের দিকে একবার তাকিয়ে যেমন মন-প্রাণ আকৃষ্যমাণ হয়, ঠিক তেমনি হবে স্বামীর মন তার স্ত্রীকে দেখে। স্বামী-স্ত্রীর এ পরম সুখ থাকলে, কোন নারী সংগঠন বা নারী-স্বাধীনতা ও নারী-মুক্তির আন্দোলনের প্রয়োজনই নেই।
নারী-পুরুষের মধুর সহাবস্থান ও
মধুর মিলনে পরম সুখ, এই শান্তিই পরম শান্তি। কিন্তু এমন স্বর্গীয় সংসার আছে কয়টা?
‘‘কোথায় গেলে তারে পাই?
যার লাগি এ বিশাল বিশেব নাই মোর কোন শান্তি নাই।’’
বলাই বাহুল্য যে, যে স্বামী তার স্ত্রীর প্রগাঢ় ভালোবাসা পায়, বিপদে সান্ত্বনা, কষ্টে সেবাযত্ন, যৌবনে পরম মিলন পায়, রাগ-অনুরাগ বা অভিমান করলে যাকে তার স্ত্রী মানিয়ে নেয় এমন স্বামীর মত সৌভাগ্যবান স্বামী আর কে হতে পারে? পিতা-মাতার দুআ ও
স্ত্রীর প্রেমেই তো রয়েছে স্বামীর প্রকৃত পৌরুষ। এমন নারী না হলে পুরুষের জীবন বৃথা।
পত্রিকা ৩৬০ এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url